চুপচাপ বিআরটিএ, গণপরিবহনের ভাড়ায় চলছে নৈরাজ্য

Passenger Voice    |    ১১:৫৩ এএম, ২০২১-০৯-২৪


চুপচাপ বিআরটিএ, গণপরিবহনের ভাড়ায় চলছে নৈরাজ্য

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা। ব্যবসায়িক কাজে প্রতিদিনই রাজধানীর নাবিস্কো বাসস্ট্যান্ড থেকে গণপরিবহনে চড়ে যেতে হয় করাইলে। তার এই পথের দূরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত নিয়মে রাজধানীতে চলাচল করা বড় বাসের প্রতি যাত্রীর ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা। সে হিসাবে গোলাম মোস্তফার ওই পথটুকু যেতে ভাড়া বাবদ খরচ হওয়ার কথা ৭ টাকা ৬৫ পয়সা। কিন্তু তাকে ভাড়া হিসেবে গুনতে হয় ২০ টাকা। প্রতি যাত্রায় তার বাড়তি ১২ টাকা ৩৫ পয়সা খরচ হয়, যা প্রকৃত ভাড়ার প্রায় তিন গুণ। এই রুটে চলাচলকারী মনজিল, আল মক্কা, আজমেরী গ্লোরী সিটিং সার্ভিস, গাজীপুর পরিবহন লিমিটেড সিটিং সার্ভিস, গুলিস্তান গাজীপুর, প্রভাতী বনশ্রী স্পেশাল সার্ভিসসহ প্রতিটি বাসই নাবিস্কো বাসস্ট্যান্ড থেকে করাইল যেতে ২০ টাকা ভাড়া আদায় করে। এভাবে শুধু গোলাম মোস্তফা একাই নন, রাজধানীতে প্রতিদিন চলাচলকারী লাখো মানুষ গণপরিবহনে চরম ভাড়া নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছেন। ভাড়া নিয়ে এই নয়ছয় যেন এখন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। নগরীর কোনো গণপরিবহনই সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলছে না। বেশিরভাগ পরিবহনই ‘সিটিং’ ‘স্পেশাল সিটিং’ ‘গেটলক’-এমন হরেক নাম ব্যবহার করে নিজেদের ইচ্ছামতো চেকিং সিস্টেম ওয়েবিল ব্যবস্থাপনা বানিয়ে এই ভাড়া নৈরাজ্য জায়েজ করছে। এমনটা বলছে দৈনিক দেশ রূপান্তর।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রিমন হাসানকে প্রতিদিন শ্যামলী থেকে শাহবাগ আসতে হয়। এই যাত্রাপথের দূরুত্ব ৬.৪ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত হারে এই পথটুকুর জন্য তার ভাড়া দেওয়ার কথা ১০ টাকা ৮৮ পয়সা। কিন্তু দিশারী পরিবহনে তার কাছ থেকে রাখা হয় ২০ টাকা, যা প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা হলেও বেশিরভাগ বাসেই সর্বনিম্ন ভাড়া কমপক্ষে ১০ টাকা নিতে দেখা যায়। যেসব বাস এই বাড়তি ভাড়া আদায় করছে সেগুলোর মানও কিন্তু লোকাল বাসের থেকে খুব একটা উন্নত না। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া, ফ্যান থাকলেও নষ্ট, পরিবহন শ্রমিকদের অপেশাদার আচরণ, বেপরোয়া গতি এবং যখন তখন যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে থাকার মতো নানা বিড়ম্বনা ও অসন্তুষ্টি নিয়েই এসব বাসে চলাচল করতে হয় যাত্রীদের।

আরো পড়ুন: ১২ কোটি টাকার ঘুষ দুর্নীতি, দুদকের জালে ধরা বিআরটিএর এডি ফারহান

ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক (রোড সেইফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘যে গাড়িগুলো আমাদের মোবাইল কোর্টের সামনে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।’ তবে এরকম জরিমানার ঘটনা সচরাচর দেখা যায় নাএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা তো প্রতিটি স্টপেজে থাকবে না।’

এ প্রসঙ্গে পরে বিআরটিএ পরিচালক এনফোর্সমেন্ট সরওয়ার আলম বলেন, ‘অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাড়তি ভাড়া বন্ধে প্রয়োজনে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে।’

বিআরটিএ কর্মকর্তারা যাত্রীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও কোথায় অভিযোগ দিতে হবে সে ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই যাত্রীদের। এ ব্যাপারে নেই কোনো প্রচারও। যাত্রীরা বলছেন, অভিযোগের কথা বলতে বলতে তাদের মুখ ব্যথা হয়ে যায়, কিন্তু দেখার কেউ নেই। এছাড়া এসব বিষয়ে যাত্রীদের অভিযোগ কোথায় দিতে হবে সে বিষয়ে কোনো বাসেই তেমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া নেই। নগরীতে চলাচলকারী বিআরটিসির বাসে শুধু একটি স্টিকার সাঁটানো থাকে। যাতে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দেওয়ার কথা লেখা থাকে।

আরো পড়ুন: বিআরটিএতে রাতারাতি পরিবর্তন হয় বদলী আদেশ, আছে বাণিজ্যের অভিযোগ

২০১৮ সালের করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, নগরীতে চলাচলরত ৯৬ শতাংশ বাস, মিনিবাস ভাড়া নৈরাজ্যের সঙ্গে জড়িত। বিশ্লেষকরা বলছে, ‘সিটিং সার্ভিস নামে কোনো কিছু সড়ক পরিবহন নীতিমালা বা বিধিমালার কোথাও কিন্তু নেই। যে বিদ্যমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাই কিন্তু সিটিং সার্ভিস। আবার সিটিংয়ের কথা বলে বাড়তি ভাড়া আদায়ের কোনো সুযোগ নেই।’ ‘গণমাধ্যমগুলো যখন সরব হয় তখনই সরকার মলম লাগিয়ে উপশমের চেষ্টা করে। তবে দেশের পরিবহন সেক্টরে আপাদমস্তক ক্যানসারের ক্ষত।’

সর্বশেষ ২০১৫ সালে বড় বাসে প্রতি যাত্রীর ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সেই নিয়মে বছরখানেক চলতে থাকে। কিন্তু বছর যেতে না যেতেই পরিবহনগুলো গাড়িতে ‘সিটিং সার্ভিস’ নাম ব্যবহার করে বাড়তি ভাড়া আদায় শুরু করে। হুট করেই দেখা যায় প্রায় সব বাসই সেবার মান না বাড়িয়ে শুধু স্টিকার বা রং লাগিয়ে যখন তখন সিটিং হয়ে যায়। যাত্রীদের এই হয়রানি বন্ধে ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পরিবহন মালিক সমিতি ও পুলিশ অভিযান শুরু করে। তখন পরিবহন মালিকেরা বাস বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। এরপর সিটিং সার্ভিস পুনরায় চালু করে এই বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে বিআরটিএ, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, নাগরিক প্রতিনিধি ও পুলিশের সমন্বয়ে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি ২৬ দফা সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন ২০১৭ সালের নভেম্বরে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। কিন্তু গত ৪ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি সেই ২৬ সুপারিশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ফার্মগেট থেকে শাহবাগের দূরত্ব ৩.৫ কিলোমিটার। ১ টাকা ৭০ পয়সা কিলোমিটার হারে এ পথটুকুর জন্য ভাড়া দাঁড়ায় ৫ টাকা ৯৫ পয়সা। সেই অনুযায়ী সর্বনিম্ন ভাড়া হয় ৭ টাকা। কিন্তু রাজধানীতে এই রুটে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসেই সর্বনিম্ন ১০ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। শুধুমাত্র বিআরটিসি, ৮ নাম্বার ও ট্রাস্ট পরিবহনে সর্বনিম্ন পাঁচ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়।

আবার বিএএফ শাহীন কলেজ বাসস্ট্যান্ড থেকে আগারগাঁও আইডিবি পর্যন্ত ৪.৫ কিলোমিটার রাস্তা। সরকার নির্ধারিত ভাড়া দাঁড়ায় ৭ টাকা ৬৫ পয়সা। কিন্তু ওই রুটে চলাচলকারী বৈশাখী, ভুঁইয়া ও আলিফ পরিবহন ওই পথটুকুর জন্য ভাড়া আদায় করে ২০ টাকা। যা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণেরও বেশি। এই পথের জন্য যাত্রীকে ১২ টাকা ৩৫ পয়সা বাড়তি ভাড়া দিতে হয়।

শাহবাগ থেকে মহাখালী পর্যন্ত ৭.৩ কিলোমিটার রাস্তা যেতে সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী ১২ টাকা ৪১ পয়সা দেওয়ার কথা। কিন্তু ওই রুটে চলাচলকারী এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরবিহন ও দেওয়ান পরিবহনসহ সব বাসই উল্লেখিত পথটুকুর জন্য ২০ টাকা ভাড়া আদায় করে।

শাহীন কলেজ বাসস্ট্যান্ড থেকে কলাবাগানের দূরত্ব ৪.৬ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া হওয়ার কথা ৭ টাকা ৬৩ পয়সা। তবে এই রুটে চলাচলকারী বিকাশ পরিবহন ওই পথটুকুর জন্য ভাড়া আদায় করে ২৫ টাকা। ফার্মগেট থেকে আসাদগেটের দূরত্ব ১.৯ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ৩ টাকা ২৩ পয়সা। তবে লাব্বাইক ও আয়াত পরিবহনের যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা।

মহাখালী থেকে রাজাবাগ পুলিশ লাইনস বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৬.১ কিলোমিটার রাস্তা। সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা ৬৩ পয়সা। কিন্তু সায়েদাবাদ গাজীপুর বলাকা সার্ভিসে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা।

মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্সল্যাবের দূরত্ব ৫.২ কিলোমিটার, যার সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ৬ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু এই রুটে রজনীগন্ধা, সিটি লিংক, মিডলাইন ও মালঞ্চ পরিবহনের যাত্রীদের ভাড়া গুনতে হয় ১০ টাকা। যাত্রাবাড়ী থেকে শাহবাগের দূরত্ব ৬.৮ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ১১ টাকা ৫৬ পয়সা। তবে এই রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের কাছ থেকে ২০ টাকা ভাড়া আদায় করছে ট্রান্স সিলভা পরিবহন, যা ৮ টাকা ২৪ পয়সা বেশি।

গাবতলী থেকে ফার্মগেটের দূরত্ব ৬.১ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ১০ টাকা ৩৭ পয়সা। কিন্তু এই রুটে চলাচলকারী লাব্বাইক ও আয়াত পরিবহনে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয় পরিবহনভেদে সর্বনিম্ন ১৫ টাকা, যা ৪ টাকা ৬৩ পয়সা বেশি।

যাত্রীদের তোলা অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডরেশনের সভাপতি শাহজাহান খান  প্রথমে, ‘কোথায় এমন হচ্ছে?’ পরে তিনি আবার বলেন, ‘এইগুলো কমপ্লেইন করতে হয়।’ সংকট নিরসনের উপায় জানতে চাইলে শাহজাহান খান বিশদ কোনো মন্তব্য না করে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘লিখিত কমপ্লেইন দেন।’

একই প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘যারা এটা করে (ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি) তাদের বিরুদ্ধে বিআরটিএ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। আমরাও নিয়ে থাকি।’ তবে এ বিষয়ে জানতে চাওয়ার শুরুতে এই পরিবহন নেতা বলেন, এত ছোট বিষয়ে তাকে কেন ফোন করা হয়েছে।